dc.description.abstract |
ধর্ম ও নৈতিকতা প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম [Kazi Nazrul Islam on Religion and Morality] শিরোনামের বর্তমান অভিসন্দর্ভের লক্ষ্য হলো ধর্ম ও নৈতিকতা সম্পর্কিত কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসন্ধান করা। এই লক্ষ্য পরিপূরণের জন্য প্রাথমিক ও সহায়ক উপকরণ থেকে পাঠ-বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক পর্যালোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
অভিসন্দর্ভের প্রথম অধ্যায়ে গবেষণার যৌক্তিকতা, লক্ষ্য, পরিধি, পদ্ধতি, এবং গবেষণার কাঠামো সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়েছে।
“ধর্ম ও ধর্ম বিশ্বাসের স্বরূপ সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম” শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়েধর্ম সম্পর্কে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হয়েছে। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে ইসলাম ধর্মের প্রতি নজরুলের দৃঢ় আস্থা তাঁর সাহিত্যে ফুটে উঠেছে। তবে প্রথাগত ধর্মের আচারিক দিকের চেয়ে এর অন্ত:স্থ দিকের প্রতি তিনি বেশিগুরুত্ব দিয়েছেন। ধর্মকে তিনি দেখেছেন সকল প্রকার সংকীর্ণতার উর্ধ্বে; যেখানে ধর্মভেদের কারণে কেউ পরহিংসার পাত্র হবে না। কিন্তু নজরুলের সমকালে ভারতবাসীর মধ্যে এই ধর্মভেদ ব্যাপকতরছিলো। সে সময়ে ধর্মান্ধরা ধর্মের ভেতরে মানবরচিত জাত-পাতের বিধানের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে খোদার সৃষ্টি মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতো। সকল ধর্মের মূল লক্ষ্য মানবকল্যাণ হলেও এরা মসজিদ-মন্দির রক্ষার নামে মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা করতো না। নজরুল ধর্মের নামে এই অধার্মিক বিধানের তীব্র সমালোচনা করেন এবং সমাজ থেকে অধার্মিক কর্মকাÐ দূর করে ধর্মের প্রকৃত বিধান প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এজন্য তিনি সকল ধর্মের উপরে মানব-ধর্মকে গুরুত্ব দেন। এর অংশ হিসেবেতিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার চিরপোষিত মনোমালিন্য দূর করে উভয়ের মিলন কামনা করেন। এ মিলনের পথে গোঁড়া ধার্মিকরা ছিলো ঘোর বাধা। নজরুল তাদের সমালোচনা করে বলেন যে, এই ধর্মান্ধদের কারণেই ধর্ম-বিদ্বেষ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে,ধর্মের প্রকৃত বার্তা বিকৃত হচ্ছে। সুফিবাদী মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়ায় ধর্মের এই আধ্যাত্মিক দিকটি নজরুলের মধ্যে ছোটকাল থেকেই বিদ্যমান ছিলো।
“ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও স্বরূপ সম্পর্কেকাজী নজরুল ইসলাম” শীর্ষক তৃতীয় অধ্যায়ে দর্শনের বহুল আলোচিত ঈশ্বর বিষয়ক আলোচনা সম্পর্কে নজরুলের দৃষ্টিভঙ্গিআলোচিত হয়েছে। এই জগতের দৃশ্যমান যে বৈচিত্রতা এর পেছনে কি কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা রয়েছেন, নাকি প্রাকৃতিক নিয়মেই বিকশিত হচ্ছে এই ধরাধাম, এই সকল দার্শনিক প্রশেড়ব নজরুলের অবস্থান সৃষ্টিবাদীদের দলে। সৃষ্টিবাদীদের মতো তিনিও মনে করেন এই জগত সৃষ্টি ও এর বৈচিত্রতারপেছনে এক অতীন্দ্রিয় পরমসত্তার অস্তিত্ব বিদ্যমান।আর এ ক্ষেত্রে নজরুল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন। জগতের ফুল-ফল, পাহাড়-পর্বত, চন্দ্র-সূর্য প্রভৃতির অপরূপ সৌন্দর্যকে ঈশ্বরের সৌন্দর্যের ছায়া হিসেবে তিনি মনে করেন। তাছাড়া নজরুল মনে করেন মানুষ যেহেতু সসীম, সেহেতু মানুষের কারণ মানুষ হতে পারে না। এর পেছনে রয়েছে এক মহাপরিকল্পনাকারী সত্তার হাত। আর তিনিই ঈশ্বর।তিনি বিনা উদ্দেশ্যে এই জগৎ সৃষ্টি করেননি। এই জগৎ প্রμিয়ার পেছনে রয়েছে তাঁর এক মহাপরিকল্পনা। নজরুল ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে তত্ত¡বিদ্যামূলক, কার্যকারণমূলক ও উদ্দেশ্যমূলক যুক্তির অবতারণা করেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের পাশাপাশি ঈশ্বরবিষয়ক নিরীশ্বরবাদ, বহু-ঈশ্বরবাদ ও দ্বি-ঈশ্বরবাদের প্রতিμিয়ায় তিনি একেশ্বরবাদের পক্ষে জোরালো যুক্তি দেন। এক্ষেত্রে সকল ধর্মের ঈশ্বরকে তিনি একই মনে করেন। হিন্দু ধর্মের হরি আর ইসলাম ধর্মের আল্লাহকে তিনি আলাদা করে দেখেননি। ঈশ্বরকে তিনি করুণাময়, ক্ষমাশীল, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সত্তারূপে দেখেছেন;যিনি মানুষকে সেবিতে বিভিনড়ব সময় বিভিনড়বভাবে আগমন করেন। মানুষের সুখে তিনি হাসেন, আবার সেই মানুষের দুখে তিনিকাঁদেন। বান্দার প্রতি এতো করুণাময় ও দয়াশীল হলেও তিনি অন্যায়কে সহ্য করেন না। সুতরাং যারাই তাঁর সৃষ্টিতে ব্যঘাত সৃষ্টি করতে চায় তাদেরকে তিনি ‘অসুর দাসিনীরূপে’ সংহার করেন। তিনি জগতের অতিবর্তী হয়েও অন্তর্বর্তী।
চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় “নৈতিকতা প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম”। এখানে তৎকালীন সমাজ প্রেক্ষাপটের আলোকে নজরুলের নৈতিক মানসবিশ্লেষিত হয়েছে। তৎকালীনসময়ে সমাজে ভেদ-বিষাদ ও অনৈতিক চর্চা সর্বগ্রাসি আকার ধারণ করেছিলো। অসমতা ছিলো সমাজের প্রতিষ্ঠিত নীতি। এমতাবস্থায় নজরুল মানুষের মধ্যে নৈতিকতাকে জাগ্রত করে একটি সাম্যভিত্তিক নৈতিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে কলম চালান। ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাকাঠামো দিয়ে যে দেশের স্বাধীনতা আসবে না তা তিনি বুঝতে পারেন। এজন্য তিনি
শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিক করে দেন। সাহিত্যিকরা কোন ধরনের সাহিত্য রচনা করবে তার দিক নির্দেশনাও রয়েছে নজরুলের সাহিত্যে। সাম্যভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি নারী-পুরুষের, ধনী-গরীবের, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ন্যায্যতার দাবি তুলে ধরেন। রাজনৈতিক নৈতিকতার দিকটিও তিনি বাদ দেননি। বরং বলা যায় যে, মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যতিনি সারাটি জীবন সংগ্রাম করেন। আর এজন্য রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক ওশাসক-শাসিতের সম্পর্ক কেমন হবে তাও তিনি দেখিয়ে দেন।সকল সম্পর্ককে তিনি নৈতিক দিক থেকে বিচার করেন। আর তাঁর এই নৈতিকতার ভিত্তি হল ধর্মীয় নৈতিকতা।কারণ তিনি ধর্মীয় নৈতিক বিধি-বিধানের অনুসরণের মধ্যেই প্রকৃত মানবকল্যাণ দেখেছেন ।
পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম হলো “আত্মার স্বরূপ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম”। নজরুল আত্মাকে দেখেন অক্ষয়, অমর, অজড় ও অবিনাশী সত্তা রূপে; যা দেহ বিনাশের পরেও অস্তিত্বশীল থাকে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনে আত্মার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘আমি’র যে ব্যবহার, নজরুলের সাহিত্যে তা ব্যাপক আকারে বিদ্যমান। বলা যায়, ‘আমি’র জয়গানই নজরুল সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য। নজরুল মনে করেন মানবাত্মা বিশ্বাত্মা তথা পরমাত্মার অংশ। সুতরাং পরমাত্মার শক্তিও মানবাত্মার মধ্যে বিরাজমান। কাজেই যে একবার নিজেকে চিনতে পারে, সে তার পরমাত্মাকে চিনতে পারে। আর একবার পরমাত্মাকে চিনতে পারলে তার দুঃখ, শোক, না পাওয়ার বেদনা সব কিছু দূর হয়ে যায়; মৃত্যুকে সে তখন আর ভয় পায় না। কারণ সে জানে, মৃত্যুর মাধ্যমে আত্মা দেহ ত্যাগ করে তার আবাসস্থল পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়। আত্মার অমরতায় বিশ্বাসী নজরুল মনে করেন,মৃত্যুর পর আর একটি জীবন রয়েছে যেখানে পুণ্যাত্মারা পুরস্কৃত হবে আর অপরাধীরা শাস্তি পাবে।
অভিসন্দর্ভের ষষ্ঠ অধ্যায়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহ থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমন্বিত করেসমগ্র গবেষণার ফলাফলকে কতিপয় উপলব্ধি-কাঠামোয় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। |
en_US |